Saturday, April 5, 2014

রোহিঙ্গা সমস্যাটি আর কতদিন? জাফর আলম

রোহিঙ্গা সমস্যাটি আর কতদিন?
জাফর আলম
প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কক্সবাজার ও বান্দরবানে নীরবে চলছে। ফলে বাড়ছে অপরাধ।’ আসলে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ফলে কক্সবাজারে অপরাধ বেড়েই চলেছে। এতে জেলাবাসী অতিষ্ঠ। রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের পর আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের চিহ্নিত করতে পারছে না। কক্সবাজার, উখিয়া, টেকনাফ, নাইক্ষ্যংছড়ি, মংডু, বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে রোহিঙ্গারা আরাকান থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে কিন্তু এদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
সম্প্রতি আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর স্থানীয় কর্মীদের আক্রমণে শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে, তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মিয়ানমার সরকার এসব সংখ্যালঘুদের জানমাল রক্ষায় কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আরাকানে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার খবর পত্রপত্রিকায় পড়েছি আমরা এবং তাদের বাড়িঘর আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে তা টেলিভিশনে দেখেছি। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে অথচ মিয়ানমার সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ব্যাপারে নীরব। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো, গণতন্ত্রকামী নেত্রী সূচির ভূমিকা। তিনি এসব সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কোন অবস্থান নেননি। দিয়েছেন দায়সারা একটি বিবৃতি, যা রোহিঙ্গাদের স্বার্থরক্ষার পক্ষেও নয়।
এবার পেছনে ফেরা যাক। সরকারীভাবে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় নিবন্ধিত অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বৈধ সংখ্যা মাত্র ২৪ হাজার। অবৈধভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বিগত পাঁচ বছর যাবত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে, বন্ধ হয়নি অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। এমনকি কক্সবাজার শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাহাড়ের উপত্যকায় লোকচক্ষুর অন্তরালে বসতি স্থাপন করেছে তারা। টেকনাফ থেকে উখিয়াসহ কক্সবাজার শহর পর্যন্ত পাহাড়ে গাছ কেটে রোহিঙ্গারা শিবির স্থাপন করে অবৈধ মাদক ব্যবসা, আগ্নেয়াস্ত্র চালান, চোরাচালান, নানা অসামাজিক কাজে লিপ্ত রয়েছে। এমনকি রামু ও উখিয়ায় বৌদ্ধমন্দিরে হামলার জঙ্গীদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংযোগ রয়েছে বলে অভিযোগে প্রকাশ।
স্থানীয় প্রশাসনের তদারকি ও পর্যবেক্ষণের অভাবে রোহিঙ্গারা অবাধে পাহাড় ও গাছ কেটে আশ্রয় শিবির তৈরি করছে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
মিয়ানমার থেকে অবৈধপথে প্রতিদিন আসছে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। এতে বিপথগামী হচ্ছে তরুণ সমাজ। ভবিষ্যত প্রজন্ম এখন মারাত্মক হুমকিরমুখে। এসব চোরাচালান বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
রোহিঙ্গারা চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। তারা স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর হামলা চালাতেও দ্বিধা করে না। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে উল্টো রোহিঙ্গা মহিলারা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করছে। জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে এমন ঘটনাও ঘটছে বলে জানা গেছে।
তাদেরকে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর ব্যবস্থা নিচ্ছে একটি চক্র। এরা সৌদি আরবে গিয়ে কাজকর্ম বাগিয়ে নিচ্ছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা নির্যাতনের কথা বলে। বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশীরা।
১৯৯৫ সালে শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত আড়াই লাখ অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো হয়। গত ১০ বছরে এদের অধিকাংশ আবার ফেরত এসেছে। সরকারও এদের নিবন্ধন দেয়নি। অনুপ্রবেশকারীরা এখন অবৈধ। স্থানীয়দের মতে কক্সবাজারের অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা না করলে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আগামী দশ বছরে জেলার মূল জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
অভিযোগ রয়েছে, তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসনের প্রলোভন দেখিয়ে মিয়ানমার ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের আবার ফিরিয়ে আনছে দালালচক্র। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে অবৈধভাবে এদের থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর নাম করে গড়ে উঠে ওই চক্র। একে কেন্দ্র করে চলছে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য।
২০০৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আলোচনার জন্য মিয়ানমার সফর করেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা শরণার্থী বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র সহকারী পররাষ্ট্র সচিব এরিক পি ওয়ার্ট ঢাকা সফর করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে মিয়ানমারে রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। তা নিশ্চিত হওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না।
এরিক পি ওয়ার্ট যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে সাক্ষাত করেন কিন্তু কোন আশার বাণী না শুনিয়ে ফিরে গেছেন। সাবেক ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক মি. এরিকের সঙ্গে আলাপের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে পশ্চিমাদের আন্তরিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ বলে উল্লেখ করেন। দাতা গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আন্তরিক নয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কিছু এনজিও এবং জাতিসংঘের একটি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশীরা চায় না রোহিঙ্গারা ফেরত যাক। কারণ হিসেবে বলা হয় এদের ধারণা রোহিঙ্গারা চলে গেলে তাদের চাকরি শেষ হয়ে যাবে।
২০১১ সালের ২৭ আগস্ট মিয়ানমারের রাজধানী নেপিফোতে ঢাকা-মিয়ানমার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে কক্সবাজারের বিভিন্ন শিবিরে অবৈধভাবে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হস্তান্তর করা হয়।
তখন মিয়ানমার এসব রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে বলে জানা গেছে। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩ ও ৪ মার্চ মিয়ানমার সফর করেন। এসময় রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়টি তিনি মিয়ানমার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতকালে উত্থাপন করেন। এই রিপোর্ট স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। প্রয়োজনে বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করা যেতে পারে।
লেখক : অনুবাদক
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment